কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রাণপুরুষ। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সকল গলিপথে যার সদম্ভ বিচরণ। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিরামহীন লেখনী তাঁকে অমরত্ব এনে দিয়েছে। নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্য আসরে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে তিনি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায় সমসাময়িক সাহিত্যকর্মীরা তার কাছ থেকে পেয়েছে প্রেরণা। চির সুন্দরের কবি রবীন্দ্রনাথ। সুন্দরের সংগে গতির অপূর্ব সমন্বয় ‘বলাকা‘। ‘বলাকা‘ কাব্যে যে গতিবাদ তা কোন একটি দার্শনিক মতবাদের পদ্যরূপ নয়, এটা কবি জীবনের গভীর সত্যানুভূতির ফল। ‘বলাকা’র গতিবাদ আকস্মিক নয়, এটা কবি অরূপানুপ্রাণিত জীবনবাদের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। ‘বলাকা’ পর্বে কবির কাব্য জীবনে যে পরিবর্তন ধারা ধীরে-ধীরে অনুসৃত হচ্ছিল, হঠাৎ একটি ঘটনায় তা অভাবনীয় রূপ ধারণ করল। ১৯১৬ সালে ‘বলাকা’ প্রকাশিত হলেও এর অনেক কবিতা ১৯১৪ হতে অর্থাৎ কবির ইউরোপ হতে প্রত্যাবর্তণের অল্প পরেই রচিত হয়েছিল। ‘বলাকা’য় এসে কবি পুনরায় মানুষের কবি হয়ে দেখা দিলেন। ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য কবি কাশ্মীরে ঝিলম নদীতে ‘হাউস বোটে’ অবস্থানের শোকাতুর হৃদয়ের ক্ষেত্র হতে অপসৃত হয়ে কল্পনার ভাণ্ডারে গিয়ে আশ্রয়ের মাধ্যমে কবি প্রতিভা গতিমন্ত্রে পুনরুদ্দীপ্ত হয়ে দেখা দিল। রবীন্দ্র কবি প্রতিভার যে বিচিত্র জীবনবাদ সমাজ জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল তা এদেশের ক্ষুদ্র জীবনক্ষেত্রে পূর্ণভাবে পাখা মেলতে না পেরে সঙ্কুচিত হয়েছিল। নোবেল পুরস্কারের সিংহদ্বার খুলে ইউরোপের বৃহৎ ক্ষেত্রে প্রবেশ করে কবি বিচিত্র মানব সমাজের যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন ‘বলাকা’ তারই পরিণিত রূপ। বলাকাতে কবি-প্রতিভা নূতন সৃষ্টির উন্মাদনায় চঞ্চল। এ না ভূকেন্দ্রিক, না ভগবৎ কেন্দ্রিক, এ সমাজ কেন্দ্রিক। বলাকা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবি কল্পনা এবং চিন্তাধারার পূর্ণতা লাভ করেছিল। ‘বলাকা’ রবীন্দ্র কবি প্রতিভা নাটকের ৩য় অংক। প্রথম অংক যতগুলো সূত্র ও সম্ভাবনা নিয়ে আরম্ভ হয়েছিল, দ্বিতীয় অংকে তা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচিত্র হয়ে তৃতীয় অংকে সম্ভাব্যতার চরমে উঠেছে। ‘বলাকা’র প্রধান লক্ষণীয় এর ছন্দ ও ভাষা। সন্ধ্যা সংগীতেই কবি প্রথম পূর্বতন ভাষার জড়তা হতে মুক্তিলাভ করেছেন। ‘মানসী’র শেষে এবং ‘সোনার তরী’তে শিল্প ধর্মের আর একটা সম্পদ কবি লাভ করেছেন। তা ভাষার সংহতিশক্তি। গতি ও সংহতির সামঞ্জস্য শ্রেষ্ঠ কবিদের কাব্যে দেখা যায়। ‘সোনার তরী’র পূর্বে কবির কাব্য যে পূর্ণতা লাভ করেনি, তার প্রধান কারণ তিনি তখন সংহতি শক্তি লাভ করেন নি। ‘বলাকা’ কাব্যের বহিরঙ্গের ন্যায় অন্তরঙ্গেও একটা পরিবর্তন দেখা যায়। চলতাধর্মী রবীন্দ্রনাথের কাব্যে যেন একটা নদীর স্রোতকে অনুধাবন করে চলেছে। পূর্বের কাব্যে যেটা পদ্মা, ‘বলাকা’য় এসে সেটা মর্ত্যধারা আকাশ-গঙ্গায় পরিণত হয়েছে। এ পূর্ববর্তী কাব্যের মত বস্তু বিশ্বের জগত নয়; কাল বিশ্বের জগত। এ জগতের প্রধান উপাদান কাল এবং তার ধর্মই চলে যাওয়া।
‘বলাকা’ গতিবাদের কাব্য, সৃষ্টির মূলে রয়েছে এক অফুরন্ত গতিবেগ। এই গতিবেগই অচল পাষাণের মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে যা জড়, নিশ্চল তার মধ্যে প্রাণ রসের সঞ্চার করে তাকে জীবন্ত করে তোলে, যার বলে তরুশ্রেণী পাখা মেলে শূন্যে উড়ে যেতে চায়, পর্বত বৈশাখের মেঘের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে চায়, পটে আঁকা ছবি জীবনের মধ্যে ফিরে আসে। গতি Eternal flux ইহার সত্য; স্থিতি মিথ্যা, মায়া মাত্র। জগতের মধ্যেই জড় পৃথক নয় এবং আমরা যাকে পরিবর্তন বলে ব্যাখ্যা করি তা জড় হতে পরিণত হয়, নিরন্তর গতিচক্রাবর্তের এক একটা মুহূর্ত মাত্র। তত্ত্ব হিসেবে এ তত্ত্ব নতুন নয়। ফরাসী দার্শনিকরাও আঁরি বেঁর্গস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে এই তত্ত্বের বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ দার্শনিকরাও এই তত্ত্ব আলোচনা করেছেন। চিন্তাশীল দার্শনিক ব্যক্তি যুক্তি পরম্পরার ভেতর দিয়ে যে পরম সত্যকে লাভ করেন। তা বোধ ও বুদ্ধির সমন্বয়ে রসবস্তুতে পরিণত করে নিবিড় ভাবে উপভোগ করে। এই রূপ রসাশ্রিত সত্যই কাব্য হয়ে দেখা দেয়।
বলাকা’তেও এই তত্ত্ব একটা বিশেষ রূপকের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। পৃথিবীর সকল জড় ও জৈবের মধ্যে অবিরাম গতির আকাঙ্ক্ষা। যতক্ষণ প্রত্যেক ঈঙ্গিত রূপ না পাচ্ছে, ততক্ষণ গতি ও পরিবর্তনের আর সীমা নেই। একটি ভেঙে আর একটার পরিবর্তনের আর একটা কিন্তু যেমনি ঈন্সিত রূপে আশ্রয় লাভ করে আত্ম অস্তিত্বে সচেতন হচ্ছে। এমনি এই অবিরাম গতির সার্থকতা এই বিশেষ মুহূর্তে হেরাক্লিয়াসের মত রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন- ‘I cannot bathe in the same river twice’ সৃষ্টির তত্ত্বের রহস্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শিল্প সৃষ্টির এক প্রান্তে সৃষ্টি অপর প্রান্তে শিল্পীর চিত্তের ক্রিয়া, মাঝখানে এই পরিবর্তনশীল গতি ও স্থিতির লীলা।
‘বলাকা‘ কাব্যে কবি যৌবনানুভূতির পরিচয় অনুভব করেছেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রথমে বিদ্রোহ পরিণতিতে সামঞ্জস্য ও শান্তিতে পর্যবসিত হয়েছে। ‘বলাকা’য় তত্ত্বের দিক দিয়ে দেখা যায়, অবিরাম গতি অবিচলিত বিনামের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে সার্থকতা লাভ করেছে। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে নিরন্তর পরিবর্তনের স্রোতধারা বয়ে চলেছে। এই বিশেষ তত্ত্বটি কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি ও ভাবাবেগের মাধ্যমে অপূর্ব কাব্যরূপ ধারণ করেছে চঞ্চলা, বলাকা, ছবি, শাজাহান প্রভৃতি কবিতায়। সৃষ্টি ও ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে এই নিরন্তর চির পরিবর্তনময় কালপ্রবাহকে কবি নদীরূপে অনুভব করেছেন। কাজেই এই চঞ্চল নদীর নৃত্যস্রোতে ধ্বংস-মৃত্যুর অবগাহনে, বিশ্ব শুচি স্নাত হয়ে নতুন প্রাণ ও রূপলাভ করে ধন্য হচ্ছে-
‘নাহি জানে কেউ-
রক্তে তোর নাচে আজি সমুদ্রের ঢেউ,
কাঁপে আজি অরণ্যের ব্যাকুলতা;
মনে আজি পড়ে সেই কথা-
যুগে যুগে এসেছি চলিয়া
স্খলিয়া স্খলিয়া
চুপে চুপে
রূপ হতে রূপে
প্রাণ হতে প্রাণে।’
সৃষ্টির এই গতিতত্ত্ব ‘বলাকা’ কবিতায় আরও সুন্দর ভাবে রূপলাভ করেছে। শ্রীনগরের ঝিলম নদীর উপর নৌকায় কবি তখন বাস করছেন। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে; অন্ধকার কাল জলের উপর তারায় খচিত আকাশের ছায়া পড়ে মনে হচ্ছে তারাকুল ভাসছে। নিস্তব্ধ দুই তীরে পর্বত শ্রেণী, তার পাশে সারি সারি দেওদার বন। মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নের কথা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছেনা, শুধু অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ আঁধারে গুমরে গুমরে উঠছে। এমন সময় এমনই পরিবেশের মধ্যে এক ঝাঁক হংস বলাকা স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করে আঁধারের বুক বিদীর্ণ করে মাথার উপর দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দূর হতে দূরান্তরে শূন্যতা হতে শূন্যতায় উড়ে চলে গেল। আধারমগ্ন গিরি শ্রেণী, দেওদার বন শিউরি উঠল, শিউরি উঠল কবির অন্তর, চিন্ত ও কল্পনা; হংস বলাকার শব্দায়মান উন্মুক্তপক্ষ স্পর্শ করল কবি চিত্তের গভীরতম স্তর; এক মুহূর্তে কবির অনুভূতি সংচকিত হয়ে ওঠে-
‘মনে হলো, এ পাখার বাণী দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
বেগের আবেগ।
… … … … … …
সুদূরের লাগি
এ সন্ধ্যায় স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি
হে পাখা বিবাগী
বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে,
হেথা নয়, হেথা নয় আর কোনখানে।’
একই ভাবাবেগ ‘ছবি‘ কবিতাতে ফুটে উঠেছে। কবির মৃত পত্নী রেখার বন্ধনে চিরকালের জন্য আবদ্ধ নয়। প্রত্যক্ষ চেতনার ক্ষেত্র হতে অপসারিত হলেও তিনি হৃদয়ের গভীরে মগ্ন চৈতন্যে অবস্থান করে ভাব ভাব ও কবিত্ব শক্তির প্রেরণা জোগাচ্ছেন। সুতরাং তিনি একটা বেগবতী শক্তি;
‘ভুলে থাকা, নয় সে তো ভোলা,
বিস্মৃতির মর্মে বসি রক্তে মোর দিয়েছ যে দোলা।
নয়ন সম্মুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই-
… … … … … …
তবু সুর বাজে মোর গানে;
কবির অন্তরে তুমি কবি
নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি।’
কালিদাসের মেঘদূত ছিল মেঘ, শাজাহানের দূত ছিল তাজমহলের সৌন্দর্য। মেঘ যেমন যক্ষের বাণীকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার প্রিয়ার কাছে; তাজমহলের অপরূপ সৌন্দর্য দূতের মত চিরকাল ধরে শাহজাহানের নীরব প্রেমের বাণী বহন করে চলেছে তাঁর মৃত পত্নীর উদ্দেশ্যে-
‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া’
বিশ্ব প্রকৃতির এই গতিবাদের সঙ্গে কবি মানব জীবনের গতির বৈশিষ্ট্য অনুভব করেছেন। বিশ্ব ধারার সাথে মানুষ ভেসে চলেছে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জন্ম হতে জন্মান্তরে-
‘পূন্য হই সে চলার স্নানে,/ চলার অমৃত পানে
নবীন যৌবন / কশিয়া উঠে প্রতিক্ষণ।
ওগো, আমি যাত্রী তাই-/চিরদিন মানুষের পানে চাই।’
দেশে দেশে দিকে দিকে মানুষের যত অন্যায়, লোভীর নিষ্ঠুর লোভ, বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ, জাতি-অভিমান, অধিষ্ঠাত্রী দেবতার বহু অসমান আজ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে, মৃত্যুযজ্ঞে আজ তা বিসর্জন দিতে হবে। চির নতুনকে বরণ করার জন্য রবীন্দ্রনাথের যৌবনানুভূতির পরিচয় আরও তীব্র হয়ে উঠেছে-
‘বলো অকম্পিত বুকে-/ তোরে নাহি করি ভয়;
এ সংসারে প্রতিদিন তোরে আমি করিয়াছি জয়।
তোর চেয়ে আমি সত্য এ বিশ্বাসে প্রাণ দিব, দেখ
শান্তি সত্য, শিব সত্য, সত্য সেই চিরন্তন এক।’
‘বলাকা’য় রবীন্দ্রনাথ নতুনতর আনন্দে মুগ্ধ হয়েছেন, যেমন হয়েছিলেন তাঁর কাব্য জীবনের মর্ত্যপ্রীতি রসে। মৃত্যুযক্ষের সাধনায় কবি গতিবাদ জীবনের গভীর সত্যানুভূতিকেই প্রকাশ করেছেন; এ মূল্যহীন নয়। সৃষ্টির গতিকে একদিন মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু এখানেই সব কিছুর শেষ নয়। সৃষ্টি ও জীবন মৃত্যুকে অতিক্রম করে নতুন গতির, নতুন মুক্তির সন্ধান লাভ করবে-
‘রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?/ নিদারুণ দুঃখ রাতে
মৃত্যুাঘাতে/ মানুষ চুশিল যবে নিজ মর্ত্যসীমা
তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?’
এই আশ্বাস ও বিশ্বাসেই কবি মৃত্যুকে স্বীকার করেছেন। সৃষ্টির গতি সত্যই একমাত্র সত্য নয়, এই গতিবেগ মুক্তি ও গতির অন্যতম সত্য। সৃষ্টি শুধু গতিসর্বস্ব হতে বীরে না, তা হলে তার সার্থকতা কোথায়? সেই সার্থকতা গতি হতে মুক্তিতে। সৃষ্টির মূলে রয়েছে এই পরম সত্যটি।